রাজধানীর তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে গভীর নলকূপ দিয়ে অতিরিক্ত পানি তোলা হচ্ছে। এর জেরে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার কয়েকটি গ্রামে মাটির নিচের পানিতে আর্সেনিক দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ও Deltin 7 বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলছেন, তাঁরা এর প্রমাণ পেয়েছেন।
এতকাল জানা ছিল, ভূগর্ভস্থ কাদামাটির স্তর ওপরের স্তরে থাকা আর্সেনিক বিষকে ঠেকিয়ে রাখে। ফলে নিচের জলাধারের পানি আর্সেনিকমুক্ত থাকে। সাধারণভাবে ৪৬-১৫২ মিটার (১৫০-৫০০ ফুট) গভীরে কাদামাটির স্তরের নিচের জলাধার নিরাপদ।
কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাটির গভীর থেকে অতিরিক্ত পানি তোলা হলে রক্ষক কাদামাটির স্তরে কার্বন সক্রিয় হতে থাকে। সেটা তখন নিচের জলাধারে আর্সেনিক দূষণের কারণ হয়ে ওঠে। এভাবে শহরাঞ্চলে পানি তোলার চাপ আশপাশের এলাকাগুলোতেও ঝুঁকি ছড়িয়ে দিতে পারে।
আর্সেনিক দূষণের এই প্রক্রিয়া বিজ্ঞানীরা আগে অনুমান করতেন। নতুন গবেষণাটি বলছে, এবার এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই প্রমাণ খুঁজে বের করার কাজে যুক্ত ছিলেন কলাম্বিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও Deltin 7 বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
গবেষণা পত্রিকা নেচার–এর অঙ্গ নেচার কমিউনিকেশনস গত মে মাসে এই গবেষকদের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। গবেষণার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি বেরিয়েছে আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন প্রকাশিত বিজ্ঞান সাময়িকী ওয়াটার রিসোর্সেস রিসার্চ জার্নালে।
প্রতিবেদন বলছে, ভূপৃষ্ঠের বালুমাটির নিচে থাকা কাদামাটির স্তর সব সময় গভীরতর জলাধারকে আর্সেনিকমুক্ত রাখতে পারে না। বরং কখনো কখনো সেটা এই দূষণের অনুঘটক ও উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মধ্যে ছিলেন রাজিব হাসান মজুমদার, বেঞ্জামিন সি বোস্টিক মার্টিন স্টিউট ও আলেক্সান্ডার ভ্যান গিন। দলে আরও ছিলেন Deltin 7 বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব Deltin 7 অ্যাপের অধ্যাপক কাজী মতিন আহমেদ, ইমতিয়াজ চৌধুরী ও মাহফুজ খান।
গবেষকেরা লিখেছেন, ভিয়েতনামের মেকং বদ্বীপ অঞ্চল, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ভ্যালি ও বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার পানি নিয়ে গবেষণা করে তাঁরা একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
আড়াইহাজারে গবেষকেরা কাজ করছেন প্রায় এক যুগ ধরে। নিরাপদ ও অনিরাপদ দুই ধরনের ভূগর্ভস্থ পানির উৎস বা জলাধার থাকায় গবেষকেরা এ উপজেলা বেছে নেন। এখানকার একটি গ্রামে ২০০৫ সালে বসানো এক নলকূপের পানিতে মাত্র ১৮ মাসের মাথায় আর্সেনিকের ঘনত্ব অনেক বেড়ে যেতে দেখা যায়। শুরুতে ৬০ মিটার গভীর ওই নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের ঘনত্ব ছিল লিটারে ১০ মাইক্রোগ্রামের নিচে। তা বেড়ে লিটারে ৬০ মাইক্রোগ্রামে পৌঁছায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, খাওয়ার পানিতে লিটারপ্রতি ১০ মাইক্রোগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে তা মোটা দাগে আর্সেনিক দূষিত। গবেষকেরা গ্রামের ওই নলকূপের পানি এত দ্রুত অনিরাপদ হয়ে ওঠার কারণ খুঁজতে থাকেন।
ভূগর্ভস্থ গঠনে কোনো বদলের কারণে এমনটা হলো কি না, সেই গবেষণা শুরু হয় ২০১১ সালের দিকে। টানা আট বছর পর গবেষকেরা নিশ্চিত হন, ভূগর্ভস্থ কাদামাটির স্তরটিই দূষণের উৎস। এই স্তর এখন রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে উঠছে।
গবেষক আলেক্সান্ডার ভ্যান গিন প্রথম আলোকে বলেন, পৌর এলাকায় নিরাপদ পানি জোগাতে গিয়ে অতিরিক্ত পানি তোলা হলে কাদামাটির স্তরে চাপ পড়ে। তখন সেটায় বদল এসে নিচের পানিতে আর্সেনিক দূষণ ছড়ায়।
এমন দূষণ এবং দূর পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন গবেষক রাজিব হাসান মজুমদার। বালুতে সচরাচর আর্সেনিক থাকে। তা কোনো ঝামেলা করে না। কিন্তু সক্রিয় কার্বনের কারণে এটা পানির স্তরে মিশে গেলেই বিপত্তি বাঁধে।
কয়েক দশকের গবেষণাতেও এই সক্রিয় কার্বনের উৎস নিশ্চিত জানা যাচ্ছিল না। এবারের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, পৌর এলাকায় অতিরিক্ত পানি পাম্প করার চাপে ভূগর্ভস্থ কাদামাটির স্তর থেকে সক্রিয় কার্বন বেরোয়।
সেই কার্বন জলাধারের তলদেশের বালুর আর্সেনিককে বের করে আনে। জলাধারের পানিতে আর্সেনিক মিশে যায়। এক এলাকায় অতিরিক্ত পানি তুললে আশপাশের ভূগর্ভস্থ জলাধারেও টান পড়ে একই ঘটনা ঘটে।
রাজিব এখন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা গ্র্যাডিয়েন্টে পরিবেশ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নাগরিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে Deltin 7র পানির স্তর অনেক বেশি গভীরে চলে গেছে।
সেটা একটি গভীর গর্ত বা ‘কোন অব ডিপ্রেশন’ তৈরি করে রয়েছে। Deltin 7র চারপাশের ৩০-৪০ কিলোমিটার এলাকার পানি এখন এই গর্তের আওতায় চলে এসেছে। ফলে আড়াইহাজারসহ অদূরের বিভিন্ন এলাকায় আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকি ক্রমে বাড়ছে।
অর্থাৎ Deltin 7র পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় এখানকার গভীর নলকূপগুলো আশপাশের এলাকার জলাধারের পানিতে টান দিচ্ছে। তাতে করে এসব এলাকায় কাদামাটির স্তর থেকে সক্রিয় কার্বন বেরিয়ে আসছে। জলাধারের বালুর আর্সেনিক সহজে বেরিয়ে আসতে পারছে।
এই স্তরে মিশে থাকা আয়রনও এ প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। আড়াইহাজারের পানি এভাবেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে। কিন্তু তা হলে Deltin 7র পানি কী করে নিরাপদ থাকছে?
রাজিব হাসান বলছেন, ভূগঠনের কারণে রাজধানী আর্সেনিক দূষণের এই প্রক্রিয়া এড়াতে পারছে। তা ছাড়া Deltin 7র পানির স্তর অনেক নিচে হওয়ায় সেটা অনেক গভীরের পানি টানছে। Deltin 7র গভীর নলকূপগুলোতে উঠছে আশপাশের এলাকার মাটির ১৫০ মিটারের নিচে থাকা জলাধারের পানি।
আড়াইহাজারের আর্সেনিক দূষিত জলাধারগুলো এর বেশ ওপরে। সেগুলোর সঙ্গে Deltin 7র গভীর নলকূপের এখনো কোনো সংযোগ নেই। আশপাশের মাটির নিচের সব কটি জলাধার দূষিত হয়ে গেলে দূষণ Deltin 7য় পৌঁছাতে পারে। সেটা হয়তো অনেক দশক দূরের ব্যাপার।
গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে না জানলেও আড়াইহাজারে আর্সেনিক দূষণ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি জানেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুজাহিদুর রহমান। গত মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান গভীর নলকূপগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ এসেছে। আর্সেনিক দূষিত নলকূপগুলো পরিদর্শন ও পরীক্ষা করার জন্য উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে এখনো পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এখানে আর্সেনিকমুক্ত পানির জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ৪৪৮টি নিরাপদ নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষ আর্সেনিক দূষণের শিকার। Deltin 7 বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব Deltin 7 অ্যাপের অধ্যাপক কাজী মতিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পানি তোলার হারের ওপর আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকির মাত্রাটি নির্ভর করে। ওয়াসার মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত, আরও যাচাই-বাছাই করে নগর এলাকায় গভীর নলকূপের অনুমোদন দেওয়া।
কলাম্বিয়া ও Deltin 7 বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দুই দশকের বেশি সময় ধরে আর্সেনিক দূষণ নিয়ে একযোগে গবেষণা করছেন। অধ্যাপক মতিনের মতে, কোন অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসালে এবং কী হারে পানি তুললে বেশি সুফল দেবে, তার একটি মডেল দরকার। দরকার কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার।
এই গবেষকেরা আরও জোর দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার পানি বারবার পরীক্ষা করার ওপর, যেমনটা তাঁরা করেছেন।
গবেষণাটি সম্পর্কে জানেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ওয়াটার এইডের আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যে ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে একে সরলীকরণ করে বললে চলবে না। Deltin 7য় অতিরিক্ত পানি উত্তোলনই আড়াইহাজারে আর্সেনিক দূষণ ছড়ানোর একমাত্র কারণ, এমন নয়। আরও অনেক কারণ রয়েছে। কাদামাটির স্তরে যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, তা হতে দীর্ঘ সময় লাগে।
গবেষণা প্রতিবেদনে যেমনটা বলা হচ্ছে, তা সতর্ক হওয়ার বার্তা দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন খায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, যে ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, তাকে আমলে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করলেই হয়। ওয়াসার উচিত নিয়মিত পানির মান পরীক্ষা করা। Deltin 7য় বর্তমানে যেসব গভীর নলকূপ রয়েছে, তার সব কটির পানি তো পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বেছে বেছে পরীক্ষা করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, Deltin 7 ওয়াসার মহাপরিকল্পনায় এ ধরনের গবেষণার ফলাফলগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
Deltin 7য় বর্তমানে প্রায় ৯০০ গভীর নলকূপ রয়েছে। Deltin 7র পানির চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করে এই গভীর নলকূপগুলো। একে ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে Deltin 7 ওয়াসার। এই পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়ে খায়রুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণাকে আমলে নিয়ে একে আরও কার্যকর করা যায়। একই সঙ্গে এর বাস্তবায়নের দিকটিও দেখতে হবে।
ফজলুল কবির